কৃষি যন্ত্রের বাজার সৃষ্টিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ


Dr. F H Ansarey

Managing Director & CEO, ACI Motors Limited, ACI Agrolink Limited, Premiaflex Plastics Limited, ACI Agribusinesses

কৃষি যন্ত্রের বাজার সৃষ্টিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ

রাজধানীর কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশনে তিন দিনব্যাপী যে কৃষি মেলা শুরু হয়েছে, সেখানে আমি অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমি দেখলাম, এই কৃষি মেলা বেশ ভালো পরিসরে হয়েছে এবং সেখানে প্রায় বিশ-বাইশটা স্টল হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি স্টল আছে, প্রাইভেট স্টল আছে। সরকারি স্টলে তাদের রিসোর্স প্রোডাক্টগুলা দেখিয়েছে। যে সমস্ত প্রোডাক্ট প্রমোট করছে সেগুলা দেখিয়েছে। প্রাইভেট স্টল নতুন নতুন টেকনোলজি দেখিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরানো টেকনোলোজির নতুন নতুন উদ্ভাবন দেখিয়েছে বা সুযোগ সুবিধা দেখিয়েছে। এই মেলার মাধ্যমে যেটা হবে যে, এটা একটা সম্প্রসারণ কাজ। কৃষিযন্ত্র বাজারটাকে সম্প্রসারণ করার জন্য কাজে লাগবে। এই বাজারটাকে বলতে আমরা বোঝাতে চাচ্ছি, কৃষকের প্রয়োজনটা হলো যে, তার প্রোডাক্টিভিটি বাড়াতে হবে। আর এই প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে যদি তার উৎপাদন খরচ কমে। আমাদের দেশে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কারণ, টেকনিশিয়ান ও লেবারের খরচ অনেক বেড়ে গেছে। তাহলে এই জায়গাটাকে রিপ্লেস করতে হবে যন্ত্র দিয়ে। যন্ত্র দিয়ে যদি রিপ্লেস করতে হয়, আমরা যদি একটা কৃষকের সাথে যন্ত্রের তুলনা করি, দেখা যাবে, একটা কৃষকের পাওয়ার পয়েন্ট ওয়ান। আর একটা যন্ত্রের পাওয়ার হচ্ছে সেভেন। তার মানে একটা যন্ত্র কৃষকের তুলনায় এতোগুন বেশী কাজ করতে পারে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে তাই যদি হয়, তাহলে স্বাভাবিক কারণে প্রোডাক্টিভিটি বাড়বে এবং কষ্ট অব প্রোডাকশন বা উৎপাদন খরচ কমে যাবে।

চাষে ৯০ ভাগ, সেচে ৯৫ ভাগ বাংলাদেশের চরম সাফল্য, এখন ধান বপন ও কাটা-মাড়াই যন্ত্রের বাজার সৃষ্টি করে, কৃষকের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে হবে। এতে কৃষক ধানের উৎপাদন খরচ ৪০ ভাগ পর্যন্ত সাশ্রয় করতে পারবে। সরকারের ভর্তুকী সাপোর্টের মাধ্যমে, সম্প্রসারণ কার্যক্রম ও প্রাইভেট কোম্পানির সহযোগিতায় এক্ষেত্রে চরম সাফল্য বয়ে আনবে।

এই মেলার মাধ্যমে কৃষক এসে দেখবে, তারা বুঝতে পারবে যে, তাদের জমিতে সমাধান দেয়ার জন্য এই সমস্থ যন্ত্রপাতি রেডি আছে। এক্সটেনশন ওয়ার্কার যারা আছে, অফিসার আছে, তারাও দেখবে যে এই সমস্থ যন্ত্রপাতি মাঠে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে এবং কৃষকরা এ থেকে লাভবান হতে পারবে। বড় ব্যাপার হলো যে, আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান এগ্রিকালচার মিনিস্ট্রি থেকে আমাদের মাননীয় মন্ত্রী এবং মাননীয় সেক্রেটারি মহোদয় মেলায় এসেছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসার সেখানে পেপার পড়লেন। এখানে দেখাগেল যে, কৃষির পুরো মার্কেটিং সিস্টেমের যতোগুলো এলিমেন্ট থাকা দরকার, সবাই কিন্তু উপস্থিত হয়েছেন। এর মাধ্যমে বাজারটা সম্প্রসারণ হবে, ব্যাবহারটা বাড়বে। যত বাজার সম্প্রসারণ হবে, ততই কৃষক তার দোরগোড়ায় সার্ভিসটা পাবে। এটাই কিন্তু মূল উদ্দেশ্য। এসিআই নিত্যনৈমিত্তিক নতুন নতুন যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছে এবং পুরনো যেসব যন্ত্র আছে সেগুলোরও নতুন নতুন মডেল নিয়ে আসছে। সেসব যন্ত্রগুলো দেখানোর সুযোগ পেলো।

এর ফলে কৃষক সম্প্রসারন করবে, সরকারের যারা বিজ্ঞানী আছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ইউনিভার্সিটি সবাই কিন্তু এর মাধ্যমে সেবা পাবে বা দেখতে পাবে জিনিসটা কিভাবে তাদের সাপোর্ট দিবে।

আমরা যদি দেখি যে, ধানক্ষেতে চাষ করার জন্য ট্রাক্টর লাগে বা পাওয়ার ট্রিলার লাগে, আর পানি দেয়ার জন্য সেচ যন্ত্র লাগে। আমাদের বাংলাদেশে এক্ষেত্রে সাফল্য কিন্তু যথেষ্ট ভালো। চাষের ক্ষেত্রে ৯০ ভাগ, আর পানি দেয়ার ক্ষেত্রে অর্থাৎ সেচের ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫ ভাগ সাফল্য এসেছে। কৃষক কিন্তু এই সেবাটা পাচ্ছে এবং অনেক ভালো ভাবেই পাচ্ছে। এখন যেটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে, সেটা হলো ধান লাগানো, কাটা বা মাড়াই করা। ধান লাগানোর সময় অনেক বেশী লেবার লাগে এবং সময় মতো না লাগাতে পারলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। সময়মতো লাগানোর জন্য লেবার সর্ট হয়ে যায়। সেসময় সবাই একসাথে লাগাতে চায় এবং অনেক ক্ষেত্রে কৃষি লেবার শহরে চলে আসে। যার কারণে প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ ভাগ লেবার সর্ট হয়। এই সময় কিন্তু যন্ত্র লাগে, যন্ত্র দিয়ে লাগাতে পারলে কষ্ট অব লেবার কমে যাবে, কষ্ট অব প্রডাকশন কমে যাবে। একই সময়ে সবচেয়ে বেশী ক্রিটিকাল হলো হারবেস্টিং। কারণ ক্ষেতে যদি ধান পড়ে থাকে, মাড়াই না হয়, বন্যা হতে পারে, বৃষ্টি হতে পারে, পোকা মাকড়ে খেতে পারে, ইঁদুরে খেতে পারে। যতো তাড়াতাড়ি ধানটা তুলে নিতে পারে, ততো কৃষকের লাভ। আবার ধান মাড়াই করতে গিয়ে যদি ৪০ ভাগ খরচ হয়ে যায় অর্থাৎ যে দামে বিক্রি করবে, মাড়াই করতে যদি তার ৪০ ভাগ খরচ হয়ে যায়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রে ধান মাড়াই করতে চায় না। আবার লেবার পাওয়া যায় না। এই দুটো জায়গাতে আমাদের বেশী আগায় নি। লাগানোর ক্ষেত্রে মাত্র পয়েন্ট ওয়ান পারসেন্ট সার্ভিস পায় কৃষক, আর মাড়াইয়ের ক্ষেত্রে পয়েন্ট ফাইভ পারসেন্ট। তার মানে, গুরুত্বপূর্ণ দুটি কর্মকান্ড যা অর্থনীতি সাশ্রয় করতে পারে, সেদুটিতে আমরা বেশি এগুতে পারিনি।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত তিন বছরে প্রোজেক্টের মাধ্যমে এই দুটো যন্ত্রে চারশো কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে। কৃষক নতুন প্রযুক্তি আস্তে আস্তে নেয়। আলটিমেটলি কি হয়েছে যে, প্রায় দু হাজার মাড়াই যন্ত্র এসছে, ধান কাটার যন্ত্র প্রায় পাঁচ হাজার চলে এসছে। কিন্তু ধান লাগানোর যন্ত্র খুব একটা আসেনি। তাহলে এই জায়গাটাতে মনোযোগ দিতে হবে, মানে একটা মার্কেট তৈরি করতে হবে। আমরা জানি যে, মার্কেটের চাহিদার সাথে কৃষকের প্রয়োজনের সম্পর্ক রয়েছে। এই মার্কেটটাকে তৈরি করতে হলে, কৃষককে বুঝাতে হবে। তাদের মধ্যে যন্ত্র নিয়ে সমস্যা আছে, তাদের মাথার মধ্যে এটা কাজ করে। সেখানে সম্প্রসারণ কর্মীদের কাজ করতে হবে। আমাদের প্রাইভেট কোম্পানি যারা কাজ করছে, তাদের এক্সটেনশনে যারা আছে তাদের কাজ করতে হবে। আর সরকারের ব্যাপক আকারে ভর্তুকি দিতে হবে। তাহলে যতো বেশী মেশিন কৃষি ক্ষেত্রে যাবে, স্থানীয় উদ্যোক্তাদের হাতে যাবে, উদ্যোক্তারা তাদের নিজেরটাও করবে কৃষকের টাও করবে। তখন একটা প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। প্রতিযোগিতার ফলে দাম কমতে থাকবে। কৃষক তখন এই সার্ভিসটা নেয়ার জন্য আগ্রহ বাড়াবে। এই মুহূর্তে ৩৭ থেকে ৪০পারসেন্ট সার্ভিসে যে সমস্ত মডেলের যন্ত্রপাতি দেয়া হচ্ছে, সেটুকু জমিতে ধান লাগাতে প্রায় ৬০ হাজার মেশিন লাগবে এবং ধান কাটতে লাগবে ৫০-৬০ হাজার মেশিন। এখন থেকে পরিকল্পণা করতে হবে, আগামী তিন বছরের মধ্যে যাতে এই ৫০-৬০ হাজার মেশিন কৃষি ক্ষেত্রে চলে যায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

আমি জানি যে অনেক বেশী ভর্তুকি লাগবে। এটা কস্টলি হবে, কিন্তু এতে লাভ বেশি হবে। আমরা দেখেছি যে, ইউরিয়া, ফসফেট,পটাশে ভর্তুকি দিলে প্রতি কেজিতে দেড় থেকে দুই টাকা লাভ হয়। আর এই সব ক্ষেত্রে ভর্তুকি দিলে পার কেজিতে সাত থেকে দশ টাকা লাভ হয়। আমি বলছিনা যে ইউরিয়া, ফসফেট, পটাশ থেকে ভর্তুকি তুলে নিতে হবে। আমি বলছি এই জায়গাতে মনোযোগ দিতে হবে। এইখানে যদি যন্ত্রপাতি দেয়া যায় বেশ কয়েকটা লাভ হবে। একটা হলো, তাড়াতাড়ি ধান হারভেস্ট করা যাবে। ধান প্রোডাকশন কষ্ট ৩০ থেকে ৪০ পারসেন্ট কমে যাবে। কৃষক বর্তমান বাজার দরে যদি ধান বিক্রি করে, লস হবে না, বরং কিছু লাভ হবে এবং দেশের মানুষ কম দামে চাল কিনে খেতে পারবে।

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এইসব যন্ত্রপাতি যাতে কোয়ালিটিটিভ হয়, কৃষক নিয়ে যেন হতাশ না হয়। আবার যারা বিক্রি করবে, তারা,যেন ঠিকমতো সার্ভিস দিতে পারে। এক বছর ফ্রি সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে। যন্ত্রপাতি তো কিছুই না প্লাস্টিক আর লোহা। এই সব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কৃষক সার্ভিস করতে পারবে না। এই জন্য বিক্রেতাকেই সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে। যেসমস্ত কোম্পানি বা সাপ্লাইয়ার এক বছর ফ্রি সার্ভিস দিবে, তাদেরকেই এইসব যন্ত্রপাতি সবরাহ করার জন্য এনলিস্টেড করতে হবে এবং সবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

এইসব আমদানি করা যন্ত্র, হাই প্রিসিসন মেশিন। একটা জিনিস মনে রাখতে উৎপাদনের সাথে রিলেটেড হলো মার্কেট। যন্ত্র মানেই হলো হাই প্রিসিসন, হাই টেকনোলজি। এটা উৎপাদনের জন্য একটা ইকনমি স্কেল লাগে। নাহলে আপনি একটা ফ্যাক্টরির জন্য পাঁচশ কোটি টাকা ইনভেস্ট করলেন। অথচ খুব বেশি বিক্রি করতে পারলেন না। আলটিমেটলি আপনার ক্যাপিটাল নষ্ট হলো। তার চেয়ে যদি মার্কেট ক্রিয়েট হয়ে যায়, তখন আস্তে আস্তে পার্টস বানাবে, বডি বানাবে, রং করবে, তখন শিখে ফেলবে স্থানীয় উদ্যোক্তারা। তখন দেখা যাবে এটা একটা সাস্টেইনেবল একটা ইন্ডাস্ট্রি হয়ে গেছে। কৃষকও ব্যাবহার করছে, লোকালি প্রোডাকশনও হচ্ছে।

এই যন্ত্রপাতিগুলোর লংজিবিটি আকার ভেদে, কোয়ালিটি ভেদে পাঁচ থেকে দশ বছর। তবে মনে রাখতে হবে, লংজিবিটি নির্ভর করছে, কি পরিমাণ সার্ভিস দেয়া হচ্ছে, কখন কতটা সার্ভিস দেয়া হচ্ছে তার উপর। পার্টস এভেইলেবল না থাকলে দেখা যাবে এক দুই একর জমির পর যন্ত্র আর কাজ করছে না বা সার্ভিস পাচ্ছেন না। এই দিকে কিন্তু খেয়াল করতে হবে এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আমি বলছি প্রতিযোগিতা সৃষ্টির কথা। আজকে যদি আমরা যে পরিমান যন্ত্র লাগে, সেই পরিমান যন্ত্র যদি দিয়ে দিতে পারি, প্রমোট করতে পারি, ডেমোনেসট্রেশন দিতে পারি, সরকার যদি এই ডেমোনেসট্রেশনকে সাপোর্ট করে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে, মেশিন কিন্তু অনেক বেড়ে যাবে। তখন কৃষক কম খরচে সার্ভিসগুলো পাবে।

সরকার এখন হারবেস্টের ক্ষেত্রে দিচ্ছে ৫০থেকে ৭০পারসেন্ট। ধান লাগানোর ক্ষেত্রে ৫০পারসেন্ট দিচ্ছে। আমার মনে হয় এই পরিমান ঠিকই আছে, এর থেকে পারসেন্ট বাড়ানোর প্রয়োজন নাই। যন্ত্রপাতির দামের ক্ষেত্রে এখন দেয়া হয় পনেরো লাখ পর্যন্ত। আমি মনে করি এটাকে বাড়িয়ে পঞ্চাশ লাখ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া উচিৎ। কারণ একটা বড় কম্বাইন্ড হারভেস্টারে ধান যা কাটবে, একটা ছোট কম্বাইন্ড হারভেস্টারে তার চেয়ে অনেক কম কাটবে। যেহেতু কাজটা তাড়াতাড়ি করতে হবে, তাই একটা বড় মেশিন পর্যন্ত এটা অনুমোদন করা উচিৎ।

একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, যদি মেশিন এভেইলেবল হয়, মেশিনের পরিমান যদি বেড়ে যায়, তাহলে কৃষকের দোরগোড়ায় কিন্তু সার্ভিসটা যাবে। কম মূল্যে যাতে সার্ভিসটা পায় এটা করতে হলে মার্কেট তৈরি করতে হবে। মার্কেট তৈরি করার জন্য সরকারের সহযোগিতা দরকার। এটা হলে কিন্তু মার্কেট বড় হয়ে যাবে। মার্কেট বড় হলে কম্পিটিশন তৈরি হবে। তাহলে কৃষক যে সময়, যখন যে সার্ভিস দরকার এবং যেই মূল্যে দরকার সেই মূল্যে পাবে, এটার উপরই জোর দিতে হবে।